মোঃ জাকির হোসেন সিকদারঃ ইতিহাসের শ্রেষ্ট সমর নায়ক সময়ের সাহসী সন্তান জিয়াউর রহমানের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি, বগুড়ার বাগবাড়ি গ্রামে। ডাক নাম ছিল কমল। বাবা মনসুর রহমান ও মা জাহানারা খাতুনের বড় আদরের সন্তান ছিলেন তিনি। জিয়াউর রহমান ছিলেন পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান। পিতামহ ছিলেন মৌলভী কামালউদ্দিন। তিনি ছিলেন শিক্ষিত , বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলতেন। দাদার আদর্শ ও ব্যক্তিত্ব জিয়াউর রহমানের শিশুমনে দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। তবে ছোট্ট কমল এর প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিল চাচা ডাঃ ক্যাপ্টেন মমতাজুর রহমান। জিয়াউর রহমানের মা জাহানারা খাতুন ছিলেন জলপাইগুড়ির বিখ্যাত টি ফ্যামিলির মেয়ে। প্রখর স্বজাত্য বোধ ছিল তার মধ্যে। তেজী, স্পষ্টভাষী মহিলা হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। পিতা মনসুর রহমান ছিলেন একজন কেমিস্ট, চাকরিজীবী। কমল বাগবাড়ির গ্রাম্যস্কুলে দুই বছর পড়াশুনা করে। এরপর কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয় তাঁকে। দশ এগারো বছর বয়স পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া চলে। এরপর পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটলো। ১৯৪৮ সালের ১ জুলাই জিয়াউর রহমান ওরফে কমলকে ভর্তি করে দেয়া হল করাচী একাডেমী স্কুলে, যার বর্তমান নাম তাইয়েব আলী আলভী একাডেমী। ১৯৫২ সালে করাচী একাডেমী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করলেন জিয়াউর রহমান। ভর্তি হলেন ডিজে কলেজে। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে একজন অফিসার ক্যাডেট হিসাবে যোগ দিলেন তিনি। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন। সামরিকবাহিনীতে তিনি একজন সুদক্ষ প্যারাট্রুপার ও কমান্ডো হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন এবং স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।করাচীতে দুই বছর চাকুরি করার পর ১৯৫৭ সালে তিনি ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে আসেন। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬৫ সালের ভারত – পাকিস্তান যুদ্ধে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে খেমকারান সেক্টরে তিনি অসীম বীরত্বের পরিচয় দেন। যুদ্ধে দুর্ধর্ষ সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য যেসব কোম্পানি সর্বাধিক বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করে, জিয়াউর রহমানের কোম্পানি ছিল এদের অন্যতম। এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সরকার জিয়াউর রহমানকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাবে ভূষিত করে। এছাড়াও জিয়াউর রহমানের ইউনিট এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য দুটি সিতারা-ই-জুরাত এবং নয়টিতামঘা-ই-জুরাত মেডাল লাভ করে। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে পেশাদার ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। সে বছরই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হয়ে জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন। এডভান্সড মিলিটারি এন্ড কমান্ড ট্রেনিং কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানিতে যান এবং কয়েক মাস বৃটিশ আর্মির সাথেও কাজ করেন। ১৯৭০ সালে একজন মেজর হিসেবে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর জিয়াউর রহমান পাকিস্তানসেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিদ্রোহ করেন এবং ২৬শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতারঘোষণা পত্র পাঠ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সংলগ্ন সেক্টরে সেনাবাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন এবং দক্ষতা ও সাফল্যের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য কৃতিত্বের ফলশ্রুতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালের জুন মাসে তিনি কুমিল্লার একটি বিগ্রেডের কমান্ডার ছিলেন।১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে, ঐ বছরের শেষের দিকে মেজর জেনারেল পদে এবং ১৯৭৫ সালের ২৫শে আগস্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। এরপর ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৭৮ সালের ৩ জুন সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম প্রত্যক্ষ গণভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন। শহীদ জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ জাগিয়ে তোলার একজন নিবেদিত প্রাণ সৈনিক। জাতীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক চেতনা সঞ্চার এবং রাজনীতিকে গণমুখী ও অর্থনৈতিক মুক্তির অভিসারী করে তোলার লক্ষ্যে তিনি গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। তিনি’ই এই দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ কর্মে উৎপাদনে জেগে ওঠে এবং শুরু হয় স্বনির্ভর ও আধুনিক বাংলাদেশের যাত্রা। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশকে গড়ে তুলেন ইমারজিং টাইগার হিসাবে। উজ্জ্বল করেন দেশের মুখ।
জাতিকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্রগ্রামের সার্কিট হাউজে সেনাবাহিনীর কিছু বিপদগামী অফিসারের হাতে শাহাদত বরণ করেন। অকাল অবসান ঘটে নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে উঠা এক জিয়াউর রহমানের।